লকডাউন শুরু হওয়ার আগে এলাকার স্কুলে স্কুলে ঘুরে বেড়াতেন। স্কুলের দিদিমণিদের কাছে তাই পরিচিত মুখ নাইটি-ঠাম্মা। আনলক পর্বে অনেক কিছু সচল হলেও স্কুল খোলেনি। তবে সে সবকে গুরুত্ব না দিয়ে এবং বয়সকে রীতিমতো বুড়ো আঙুল দেখিয়ে কাজ শুরু করে দিয়েছেন তিনি।
পলতার বাসিন্দা কাদম্বিনী ধর। যদিও এলাকায় নাইটি-ঠাম্মা নামেই পরিচিত তিনি। বয়স ৮২। এক ছেলে ও বউমার সংসারে একমাত্র রোজগেরে তিনিই। তাই আনলক পর্ব শুরু হতেই নাইটির ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে পড়েছেন বৃদ্ধা। এলাকার স্কুলগুলি বন্ধ। অগত্যা এখন বাড়ি বাড়ি গিয়ে কড়া নাড়ছেন তিনি।
ইছাপুরের বাসিন্দা জুহি চক্রবর্তীর বাড়িতেও একদিন গিয়ে কড়া নাড়েন নাইটি ঠাম্মা। শীর্ণ চেহারার বৃদ্ধাকে দেখে জুহি ভিক্ষা স্বরূপ কিছু টাকা দিতে যান। কিন্তু তখনই বৃদ্ধা বলে ওঠেন, “মামনি একটা নাইটি কিনবে?” করোনা কালের ভর দুপুরে বৃদ্ধার এহেন আবদার শুনে তখনই হতভম্ভ হয়ে যান জুহি।
১০ থেকে ১২ টার বেশি নাইটি বয়ে নিয়ে আসতে শরীর সায় দেয় না। মেন রোডে অটো ভরসা হলেও, পাড়ায় পাড়ায় নাইটির ব্যাগ বয়েই বাড়ির দরজায় গিয়ে কড়া নাড়েন। বড় অ্যাপার্টমেন্টে সিঁড়ি ভেঙে চারতলা পর্যন্ত ওঠেন। কিন্তু ছেলে ও বউমা থাকতেও তাঁর উপরেই কেন রোজগারের ভার? জুহি জানান, বৃদ্ধার বিয়ে হয়েছিল এক রেডিও শিল্পীর সঙ্গে। তাঁর নাম হরেকৃষ্ণ ধর।
কিন্তু বৃদ্ধার আর তাঁর সঙ্গে সংসার করা হয়নি। স্ত্রী ও এক ছেলেকে ছেড়ে গিয়ে অন্য জায়গায় সংসার পেতেছিলেন হরেকৃষ্ণ। ছেলে বড় হলে মাছ বিক্রি করা শুরু করেন। বিয়েও হয়। কিন্তু সাইকেলে করে একদিন মাছ বিক্রি করতে গিয়ে পড়ে যান তিনি। ব্রেন স্ট্রোক হয়ে মানসিক ভারসাম্য হারান ছেলে। সারাদিন ছেলের দেখাশোনা করেন বউমা। তাই রোজগার করতে কাঁধে ব্যাগ নিয়ে বেরোন ৮২ বছরের নাইটি ঠাম্মা।
আজকাল অনলাইনে জিনিসপত্র কেনাবেচার হার অনেকটাই বেড়েছে। বহু মানুষ এই লকডাউনের মধ্যে ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম ও হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে পোশাক থেকে শুরু করে নানা প্রয়োজনীয় সামগ্রী বিক্রি করেছেন। ইছাপুরের বাসিন্দা জুহি নিজেও হ্যান্ডমেড ও নানা রকমের গয়না বিক্রি করেন। তাই অনলাইনে বিক্রির পদ্ধতি সবটাই জানা তাঁর। বৃদ্ধা যেদিন আসেন, সেদিনও জুহি ক্রেতাদের পাঠানোর জন্য গয়না প্যাক করছিলেন। সেগুলি দেখে বৃদ্ধা জানতে চান, তাঁর নাইটিও কি এভাবে অনলাইনের মাধ্যমে বিক্রি সম্ভব?
যেমন ভাবা, তেমন কাজ! জুহির কথায়, “ছবি তুললাম এবং বন্ধুদের পাঠালাম। সকলে মিলে ১২টা নাইটি কিনে নিয়েছেন।” এর পরে বৃদ্ধার নাইটি যাতে ইন্টারনেটের মাধ্যমে দূরের মানুষের কাছেও পৌঁছয় সেই দায়িত্বও নেন তিনি। বৃদ্ধার ছবি সমেত একটি পোস্ট করেন ফেসবুকে। ভাইরাল হয় সেই পোস্ট। দুদিনের মধ্যেই সেই পোস্টের সাহায্যেই ৪০টির বেশি নাইটি বিক্রি হয়ে যায়।
একজন সেলারের থেকেই এই নাইটিগুলি নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় বিক্রি করেন বৃদ্ধা। বিক্রি করে মালিকের থেকে প্রত্যেক নাইটির জন্য ২০-৩০ টাকা পান তিনি, যা খুবই সামান্য। জানান জুহি। বৃদ্ধা যাতে কিছু বেশি টাকা পান তাই অন্য সেলারদের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন ইছাপুরের তরুণী। জুহির পোস্ট দেখে পলতা এলাকার স্কুল শিক্ষিকারাও যোগাযোগ করেছেন। এঁরা স্কুল চলাকালীন বৃদ্ধার থেকে নাইটি কিনতেন। কিন্তু তার পরে আর সম্ভব হয়নি। জুহির এই পোস্টে তাঁরাও নাইটি ঠাম্মার খোঁজ পেয়েছেন।
এত কম সময় প্রায় সব নাইটিই বিক্রি হয়ে গিয়েছে শুনে বৃদ্ধা অবাক। তিনি জিজ্ঞাসা করেন, “এত নাইটি কে নিল” খুশি হয়ে বৃদ্ধা বলেন, “মামনি একটা নাইটি রাখ।” জুহি বলছেন, “ভীষন রাগ হয়েছিল। বললাম বুড়ি তোমার হয় না? হেসে বলল না রে। এইটা আমি দিলাম। ভাষা ছিল না। এইটুকু থেকেও মানুষ কীভাবে পারে উপহার দিতে? সন্মান জানালাম ভিক্ষাবৃত্তি না বেছে নিয়ে এই বয়সে লড়াইটা বেছে নেওয়ার জন্য।”