কিছুদিন আগে আদিম মানুষের পায়ের ছাপের সন্ধান মিলেছিল যুক্তরাষ্ট্রের হোয়াইট স্যান্ডস ন্যাশনাল পার্কে। সেখানের শুকিয়ে যাওয়া এক নদীখাত থেকে ১৩ হাজার বছর আগের আদিম মানুষের জীবাশ্মে পরিণত হওয়া পায়ের ছাপ উ’দ্ধার হয়। সম্প্রতি মা’র্কিন নৃতাত্ত্বিকরা নিউ মেক্সিকোর ওই পার্কে এসব পায়ের ছাপ উ’দ্ধার করেছেন।
তবে এবার পাওয়া গেল মানুষের হাতের ছাপ। এই গু’হার নামই হয়ে গেছে কুয়েভা দে লাস মানোস। স্প্যানিশ ভাষায় যার অর্থ হলো “হাতের গু’হা”। গু’হাটি আর্জেন্টিনার সান্টা ক্রুজ প্রদেশের অংশ যা পেরিতো মোরেনো থেকে প্রায় ১৬৩ কিঃমিঃ(১০১মাইল) দক্ষিণে অবস্থিত। এই গু’হাটি পান্টোগোনিয়ান,পিন্টুরাস নদীর উপত্যকায় অবস্থিত।
গু’হাটি ১৯৪১ সালে আবি’ষ্কৃত হয়েছিল। তবে উনিশ শতক থেকে, বিভিন্ন ভ্রমণকারী, অ’ভিযাত্রী, অন্বেষণকারী এবং বিজ্ঞানীরা পিন্টুরাস নদীর চারপাশে ভ্রমণ করেছেন। খ্যাতিমান ইংরেজী ভ্রমণকারী জর্জ মিস্টার ১৮৮১ সালে পিন্টুরাস নদী উপত্যকায় ঘুরে বেড়াতে প্রথম শ্বেতা মানুষ ছিলেন। তবে তিনি এই চিত্রগু’লো আবি’ষ্কার করতে পারেন নি।
এরপর মোরেনোর অনুসন্ধানের বিখ্যাত সহচর ক্লেমেস্ট ওনলির স’ঙ্গে ১৯০৪ সালে এই চিত্র খুঁজে পান। তবে কোনো প্রমাণ স’ঙ্গে অ্যানতে পারেন নি। ফলে এটি তারাই প্রথম আবি’ষ্কার করেছেন বলে দাবি করতে পারেন না।। এর প্রায় আধা শতাব্দী পরে ১৯৪১ সালে আলবার্তো এম ডি আগোস্টিনি নামে একজন পুরোহিত এসে গু’হার চিত্রগু’লোর দেখা পান।
আর তারপর এই চিত্র নিয়ে তার ধারণা সম্পর্কে একটি বইয়ে লেখেন। তার “লস অ্যান্ডিস” বইতে এই গু’হার চারটি ছবি প্রকাশ করেছিলেন। সেটা ১৯৫০ সালের কথা। এরপরই এই গু’হা নিয়ে শুরু হয় গবেষকদের গবেষণা।
তারা জানান, এই অঞ্চলে বহু গিরিখাত এবং পাহাড় রয়েছে। কার্বন ডেটিংয়ের মাধ্যমে জানা যায় এই ছাপের বয়স ৯,০০০ থেকে, ১৩,০০০ বছর আগের।এই গু’হার দেয়ালে বিখ্যাত চিত্রকলার একটি সারি আছে যার কারনে গু’হাটি বিখ্যাত।
এই ছাপ পান্টোগোনিয়ান শিকারী মানুষদের দ্বারা তৈরি করা হয়েছিল বলে ধারণা গবেষকদের। এই সম্প্রদায়রা দক্ষিণ আমেরিকার অত্যন্ত প্রাচীন। এই গু’হায় বিভিন্ন সময় বিভিন্ন মানুষ বসবাস করতো। তবে তাদের মধ্যে সবচেয়ে সাম্প্রতিকতম ছিল তেহুয়েলচে।
গু’হাটি ৬০০ হেক্টর (১,৫০০ একর) এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে আছে। গু’হাটির দৈর্ঘ্য ২৪ মিটার (৮১৪ ফুট) এবং এর প্রবেশদ্বার ১৫ মিটার (৪২ ফুট) প্রশস্ত এবং ১০ মিটার (৩৩ফুট) উচু।
গু’হাটির গভীরতা ১৫ মিটার গু’হার ভিতরে একটি খাড়া ঢাল আছে। গু’হার ভিতরে উচ্চতা ২ মিটারের (৬.৬ ফুট) বেশি না। এটি একটি জটিল গু’হা এর আরেকটি অংশের দৈর্ঘ্য প্রায় ১৬০ কিঃমিঃ। প্রত্নতত্ত্ববিদরা আবি’ষ্কার করেছেন যে এই গু’হায় বসবাসকারী মানুষেরা গু’হার দেয়ালে রঙ ছড়ানোর জন্য হাড় খোদাই করে পাইপ তৈরি করত।
পাত বা ফলক হিসেবে তাদের হাতকে ব্যবহার করে লাল, বেগু’নি হলুদ,এবং বাদামী বিভিন্ন রঙের শত শত হাতের ছাপ তৈরি করত। এই রঙগু’লো লৌহ অক্সাইড (লাল এবং বেগু’নী) চীনামাটি(সাদা), ন্যাট্রোজারোসাইট(হলুদ) এবং ম্যা’ঙ্গানিজ অক্সাইড (কালো) থেকে তৈরি করা হয়।
এখানে ৮২৯ টি ছাপের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ছাপ পুরুষের। তাদের মধ্যে একজনের ছাপে ছয়টি আ’ঙ্গু’ল রয়েছে। মাত্র ৩১টি ডান হাত। অধিকাংশ বাম হাত যা থেকে এটা বোঝা যেত যে শিল্পীরা ডান হাত দিয়ে তাদের নিজেদের হাত আঁকত।
এখানে কিছু শিল্পকলাও রয়েছে, যেমন গু’য়ানাকোস ও রিয়া পক্ষী সহ মানুষ এবং পশুদের সম্মিলিত শিকারের দৃশ্য এবং এর পাশাপাশি বিভিন্ন আকৃতি এবং আঁকাবাঁকা বিমূর্ত নকশা দেখা যায়।
আরো পড়ুন: কূপ খুঁড়েই বাংলায় প্রথম ফাঁ’সি দেয়া হয় যে অভাগাকে
ধারণা করা হয় গু’হাচিত্রের ব্যক্তিরা হলো ১৯ শতকের ইউরোপীয় বসতি স্থাপনকারী পান্টোগোনিয়ায় ঐতিহাসিক (শিকারী গোত্রের) সম্প্রদায়ের পূর্বপুরুষ ‘হতে পারে।
কি কারনে গু’হার ভিতরে এই হাতের ছাপ দেয়া হয়েছে?
কারো মতে একটি অনুষ্ঠান বা রীতির অংশ হিসাবে কিশোর বয়সের হাতগু’লোর ছাপ রেখে দেয়া হয়েছিল। কারণ হাতের ছাপগু’লো দেখলে বোঝা যায় যে প্রা’প্ত বয়স্কদের হাতের ছাপ নয়। আরেকটি জনপ্রিয় তত্ত্ব হল যে চিত্রগু’লো একটি ধ’র্মীয় অনুষ্ঠানের অংশ হিসেবে তৈরি করা হয়েছিল। যা শিকারে বের হওয়ার আগে করা হয়। আবার ‘হতে পারে শিকারে কত জন গেল এবং ফিরে এলো তার হিসাব রাখা ‘হত এভাবে। তবে এগু’লো সবই ধারণা মাত্র।
যে কারনেই হাতের ছাপ দেয়া হোক না কেন গু’হাটি মানবজাতির একটা বড় সম্পদ এটাই সবচেয়ে বড় কথা। এই গু’হাটি ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ তালিকাভুক্ত। ১৯৯১ সাল থেকে, ল্যান্ডমা’র্ক ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ লিস্টে রয়েছে এবং এটি ঐতিহাসিকভাবে গু’রুত্বপূর্ণ স্থান হিসেবে বিবেচিত।
চাইলে আপনিও ঘুরে আসতে পারেন এই ঐতিহাসিক স্থান থেকে। সাক্ষী ‘হতে পারেন হাজার হাজার বছর আগের মানুষের হাতের ছাপের। এজন্য অবশ্য আপনাকে যেতে হবে আর্জেন্টিনার সান্টা ক্রুজ প্রদেশে।