









কখনোই আর্থিক অবস্থা প্রতিভাকে হারাতে পারে না, তার ভুরি ভুরি প্রমাণ পাওয়া যায় সারা বিশ্বে জুড়ে ।যেখানে প্রতিভা বরাবরই উপরে উঠে এসেছে আর্থিক ও শারীরিক অবস্থার প্রতিকুলতাকে অতিক্রম করে। আজকের আমাদের প্রতিবেদনের এই নায়ক সেই কথাকে আবার সবার সামনে তুলে ধরে। প্রতিভা কোন বংশ বা সামাজিক প্রভাব বা প্রতিপত্তি দেখে আসে না এটা সহজাত এক ব্যাপার।





আর প্রতিভার বিকাশে যা অন্যতম সহায়ক হয়ে দাঁড়ায় তা হলো পরিশ্রম এবং কোন পরিশ্রম এবং কোন কিছু পাওয়ার আগ্রহ অর্থাৎ সাফল্য অর্জন করার জেদ। এই সকল চারিত্রিক এবং মানসিক গুন যে মানুষের মধ্যে প্রথম থেকেই থাকে তারাই অর্জন করে বিরল কৃতিত্ব। এমনই বিরল কৃতিত্ব অর্জন করেছেন আজকের আমাদের প্রতিবেদনের হিরো।





নাম রমেশ ঘোলাপ ,যাকে তার গ্রামের মানুষ ডাকনামে রামু হিসেবে চেনে। মহারাষ্ট্রের শোলাপুর জেলার বারসই তালুকার মহাগাও গ্রামের এই মানুষটি নিজের জেদ প্রতিভা এবং অধ্যবসায়কে সাথী করে অর্জন করেছে এক বিরল কৃতিত্ব। শারীরিক প্রতিবন্ধী এই মানুষটি জীবনের লড়াইয়ে জয়ী হয়েছেন এবং পৌঁছেছেন সফলতার শীর্ষে। এক সময় চুড়ি বিক্রি করে সংসার চালানো এই মানুষটি আজকে একজন সফল আই এ এস অফিসার।





জন্ম এক সাধারণ নিম্নবিত্ত বা এক কথায় বলতে গেলে গরিব পরিবারে। তার বাবা গরাখ গোলাপ সাইকেল মেরামতের দোকান করে চারজনের পরিবারের ভরণপোষণ করতে চেষ্টা করতেন। কিন্তু মদ্যপ হওয়ার জন্য তার শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে থাকে এবং বাধ্য হয়ে পরবর্তী সময়ে তাকে তার সাইকেল মেরামতের দোকান বন্ধ করতে হয়।





রমেশ বাবুর মা বিমলা ঘোলাপ সংসার চালানোর জন্য কোন কিছু না ভেবে চুড়ি বিক্রি শুরু করেন পাশের গ্রামগুলিতে আর রমেশ বাবুও তার এই কাজে সাহায্য করতে এগিয়ে আসেন কারণ কিছু না করলে তো পেটে ভাত জুটবে না।রমেশ বাবুর ছোটবেলা থেকে বাম পা বিকলাঙ্গ ছিল পোলিওর কারণে।





সেও তার ভাই তার মায়ের সঙ্গে ঘুরতে থাকে চুড়ি বিক্রি করার সময় এবং চিৎকার করে বলতে থাকে,”চুড়ি নিয়ে যাও ,সবাই চুড়ি নিয়ে যাও, সুন্দর সুন্দর চুড়ি কিনে নাও”। আর তাদের এই ডাক শুনে গ্রামের মহিলারা ছুটে আসত তার মায়ের কাছে এবং তার মা তখন সে সব মহিলাদের চুড়ি বিক্রি করে প্রতিদিন উপার্জন করতো।





ছোটবেলা থেকেই পড়াশোনায় প্রতি আগ্রহ ছিল রমেশ বাবুর চোখে পড়ার মতো। আর তার মধ্যে প্রতিভার কোন অভাব ছিল না। তাই গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করার পর গ্রাম ছেড়ে তাকে চলে আসতে হয় বরশিতে কাকার বাড়িতে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করার জন্য। কারণ গ্রামে প্রাথমিক বিদ্যালয় ছাড়া আর কোন বিদ্যালয় ছিল না।





তাই পরিবারের দারিদ্র্য দূর করার জন্য তার কাছে একটাই রাস্তা খোলা ছিল ,আর সেটা ছিল শিক্ষা গ্রহণের মাধ্যমে উপযুক্ত এবং ভালো একটা সরকারি চাকরি জোগাড় করা। কিন্তু এত দারিদ্র্যে তার জীবন অতিবাহিত হয়েছে যে, যখন দ্বাদশ শ্রেণীতে বার্ষিক পরীক্ষা চলাকালীন তার বাবার মৃত্যুর খবর পায় ,তখন বাসে চেপে বরশি থেকে তার গ্রাম আসার জন্য একজন বিকলাঙ্গ শিশুর যে মাত্র দু টাকা বাসভাড়া লাগে তাও তার কাছে ছিল না।





তার বাবার শেষকৃত্ত্য অনুষ্ঠানে যোগ দিতে পারার মতো অবস্থায় ছিলো না যদি না তার প্রতিবেশীরা তাকে সাহায্য না করতো সেই সামান্য টাকা দিয়ে। কিন্তু মেধাবী রমেশ বাবু তার শিক্ষক মহাশয়দের সহায়তায় এবং তার পরিশ্রম ও অধ্যবসায়ের ফলে উচ্চমাধ্যমিকে ৮৮.৫% মার্কস নিয়ে সফলতার সঙ্গে পাস করেন।





এত ভাল রেজাল্ট করার পরও রমেশ বাবু উচ্চশিক্ষার জন্য চেষ্টা করেনি ,কারণ উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করার জন্য যে আর্থিক অবস্থা দরকার তা রমেশ বাবুর পরিবারের ছিল না ।তাই তার কাছে লক্ষ্য বলতে ছিল যে কোনো উপায় একটা সরকারি চাকরি জোগাড় করা আর । সেই লক্ষ্যে তিনি প্রথমে ডি এল এড অর্থাৎ ডিপ্লোমা ইন এডুকেশন কোর্সে ভর্তি হন সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানে।





একই সময় তিনি মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কলা বিভাগে গ্রাজুয়েট হন। পরবর্তী সময়ে ২০০৯সালে তিনি সরকারি বিদ্যালয় শিক্ষাকতার কাজ পেয়ে যান। কিন্তু শিক্ষক হওয়া তার জীবনের শেষ লক্ষ্য ছিল না ।বরাবরই তার মধ্যে ছিল এক প্রতিবাদী চরিত্র। যখনই গ্রামের রেশনের দোকানে কেরোসিন তেল আনতে গিয়ে বা রেশনের সামগ্রী পায়নি তখনই সে প্রতিবাদে গর্জে উঠেছে।





এছাড়াও বিপিএল তালিকাভুক্ত হওয়ার পরও তার মা ইন্দিরা আবাস যোজনা বাড়ি পাওয়ার জন্য ন্যূনতম আর্থিক সাহায্য পায়নি সরকার এবং রাজনৈতিক দলের সহযোগিতায় ।আর তাই তার মনের মধ্যে ছিল সিস্টেমকে পরিবর্তন করার এক অমোঘ ইচ্ছা। তার কলেজে পড়ার সময় রমেশ বাবু ছাত্রসংসদের একজন সক্রিয় সদস্য ছিলেন এবং কলেজের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজে তাকে যেতে হতো জেলা প্রশাসন অফিস ।





এই অফিসে তিনি দেখেছিলেন একজন সরকারি কর্মচারী হিসেবে তেহশিলদার মশাইয়ের ক্ষমতা। আর তাই রমেশ বাবু মনে মনে স্থির করেছিলেন তাকেও এরকম একজন উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন অফিসার হতে হবে। কিন্তু এ অফিসার হওয়ার জন্য কি রকম যোগ্যতা দরকার বা কোন ধরনের পরীক্ষায় পাস করলে এধরনের অফিসার পর্যায়ের চাকরি পাওয়া যায় তা তার ধারণা ছিল না।





আর সেই লক্ষ্যেই ২০০৯ সালে রমেশ বাবু যাত্রা শুরু করেন। তার মা একজন স্বয়ংবর গোষ্ঠীর সদস্য হওয়ায় সেই গোষ্ঠী থেকে কিছু আর্থিক সাহায্য ঋণ হিসেবে নিয়েছিলেন, সেই ঋণের টাকা নিয়ে রমেশবাবু বেরিয়ে পড়েন পুনের উদ্দেশ্যে অর্থাৎ তার কাছাকাছি অঞ্চলে এরকম প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার প্রশিক্ষণ নেওয়ার কোনো রকম ব্যবস্থা না থাকায় তাকে পুনেতে আসতে হয়।





রমেশ বাবুর নিজের কথায় ,”জীবনে আমি কোনদিন এম পি এস সি বা ইউ পি এস সি পরীক্ষার নাম শুনিনি। ছোটবেলা থেকেই গ্রামে বড় হয়ে উঠেছি তাই এই সব পরীক্ষার কথা আমি কোনদিন শুনিনি। পরবর্তী সময়ে যখন আমি পুনেতে গিয়েছিলাম, তখন একজন প্রশিক্ষকের কাছে আমার প্রথম জিজ্ঞাসা ছিল এই পরীক্ষায় বসার যোগ্যতা কি আমার আছে?





তিনি যখন আমাকে জানান হ্যা ,আমি পরীক্ষায় বসতে পারি তখন থেকেই আমি এই পরীক্ষায় বসার সিদ্ধান্ত নি। ২০১০ সালে যখন আমি এই পরীক্ষায় প্রথম বসেছিলাম তখন সেই বছর আমি সফলতা অর্জন করতে পারিনি, কারণ এই বিষয়ে আমার কোন সম্যক জ্ঞান বা ধারণা ছিল না। এই বছরই আমার জীবনে আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে।





যখন আমার গ্রামের পঞ্চায়েত নির্বাচনে আমার মাকে পঞ্চায়েত প্রধানের পদে আমি দাঁড় করায় ,কারণ আমি এবং আমার বন্ধুরা চেয়েছিলাম মা পঞ্চায়েত প্রধান হলে আমাদের পরিবারের মতো আরো দুস্থ গরিব পরিবারকে সাহায্য করবো ।কিন্তু আমার মা অল্প কয়েক সংখ্যক ভোটে হেরে যায় তার ফলে আমার মধ্যে আরও জেদ অনেক বেড়ে যায় এবং আমি আরো কঠোর অধ্যবসায় শুরু করি সফলতা পাওয়ার জন্য।





আমার একটাই লক্ষ্য তৈরি হয় যেভাবেই হোক আমাকে ইউ পি এস সি পরীক্ষায় সফল হতে হবে ।সেজন্য আমি বিদ্যালয় এর শিক্ষক মহাশয় এর চাকরি ছেড়ে দেওয়ার মত কঠিন সিদ্ধান্ত নিতেও পিছপা হয়নি। তারপর আমি দ্বিতীয়বারের জন্য ইউ পি এস সি পরীক্ষায় বসেছিলাম এবং আমি সফলতা অর্জন করেছিলাম এবং সর্বভারতীয় স্তরে ২৮৭রাঙ্ক করেছিলাম পরবর্তী সময়ে।





তাই আমি মনে করি সফলতা অর্জন করতে গেলে প্রথমে যেটা দরকার তা হলো জেদ সাফল্য পাওয়ার এবং অবশ্যই তার জন্য উপযুক্ত পরিশ্রম। আমি বিশেষ কোনো প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানে এই পরীক্ষায় সফলতা অর্জন করার জন্য কোন প্রশিক্ষণ নিয়ে নি তবুও আমার অধ্যাবসায় এবং অন্যান্য সকলের সহযোগিতা আমাকে এই সাফল্যের শিখরে পৌঁছে দিতে সাহায্য করেছে। তাই নিজের প্রতিকূলতাকে কখনোই বাধা ভাবলে চলবে না। প্রতিকূলতাকে শক্তি করে এগিয়ে যেতে হবে তবেই সাফল্য অর্জন করা যাবে।এটাই আমি সবার কাছে তুলে ধরতে চাই।”





আজ রমেশবাবু বর্তমানে ঝাড়খণ্ডের এনার্জি ডিপার্টমেন্টের যুগ্ম সেক্রেটারি পদে তার কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন এবং বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তিনি তার জীবনের সফলতার কথা তুলে ধরেছেন শিক্ষার্থীদের অনুপ্রাণিত করার জন্য। আমরা কি পারি না এই মহান মানুষটির জীবনের লড়াই কে সামনে রেখে আমাদের জীবনে সফলতা অর্জন করা চেষ্টা করতে?
























