









বর্তমানের ‘বর্ধমান’ মুঘল আমলে ‘শরিফাবাদ’ নামে পরিচিত ছিল। ‘শরিফাবাদ’ নামটি বাদশাহি নাম। ‘আইন-ই-আকবরিতে’ এ নামের উল্লেখ আছে। হিন্দু, মুসলিম, শাক্ত, বৈষ্ণব ধর্মের মহামিলনক্ষেত্র ছিল এই শরিফাবাদ।





দিনটি ছিল ১৮৫৪ সালের ১৫ই অগাস্ট। সেদিন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রথম ট্রেনটি ছাড়ে হাওড়া থেকে বর্ধমান। ১০৮ কিলোমিটার দূরত্ব আসতে সময় লেগেছিল সাড়ে বারো ঘন্টা। যাত্রীসংখ্যা ছিল এক হাজার। এরা প্রত্যেকেই ছিলেন অতিথি যাত্রী।





এখন মেইন লাইনে হাওড়া থেকে বর্ধমান যেতে সময় লাগে প্রায় আড়াই ঘন্টা। আর কর্ড লাইনে গেলে সময় কমে দাঁড়ায় সওয়া দু’ঘন্টার মতো। বর্ধমান স্টেশনে নেমে রিক্সায় নলিনাক্ষ বসু রোড ধরে পশ্চিমে গেলে প্রথমে পড়বে প্রতাপেশ্বর শিবমন্দির। কিছুটা এগিয়ে গেলেই বাঁকা নদীর উত্তর তীরে রাধানগর পল্লীর দক্ষিণে সর্ব্বমঙ্গলা মন্দির।





বিশাল অঙ্গনের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে বিশাল আকারের নবরত্ন মন্দির। সর্ব্বমঙ্গলা মন্দিরে প্রবেশদ্বারের উত্তরভাগে কারুমন্ডিত মন্দিরের গর্ভগৃহে স্থাপিত আছেন ধনেশ্বরী শক্তিদেবী ও ধনেশ্বর শিব। এই মন্দির নির্মাণ ও বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন মহারাজা মহতীচাঁদের কন্যা ধনদেহি দেবী। প্রতিষ্ঠা কাল ১৮৭৪সালের ২রা আষাঢ়। সর্ব্বমঙ্গলা মন্দির প্রাঙ্গণে শিব মন্দির আছে পাঁচটি। এরমধ্যে আটচালা শিব মন্দির দুটি নির্মিত হয়েছিল রাজা চিত্রসেনের আমলে। নাটমন্দির সংলগ্ন কারুমন্ডিত শিব মন্দির আছে তিনটি। নাটমন্দিরের দেওয়ালে লেখা আছে –





বর্ধমানাধিষ্ঠাত্রী দেবী
সর্ব্বমঙ্গলা মন্দির
অবিভক্ত বাংলার প্রথম “নবরত্ন” মন্দির
দেবী কষ্টি পাথরে অষ্টাদশ ভূজা
সিংহ বাহিনী মহিষমর্দ্দিনী লক্ষ্মী রূপী মূর্ত্তি
১৭০২ খ্রীষ্টাব্দে বর্ধমানের মহারাজ কীর্ত্তিচাঁদ মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন।
বিশাল নবরত্ন মন্দিরের গর্ভগৃহে রূপার সিংহাসন দেবীর আসন। কষ্টিপাথরে খোদিত দেবী অষ্টাদশভূজা। মূর্তির চরণতলে মহিষ। মহিষমর্দিনী মূর্তি এখানে সর্ব্বমঙ্গলা নামে পূজিত হন। মন্বন্তরা মূর্তি নামেও এই বিগ্রহ অভিহিত। মূর্তির নিচে অস্পষ্ট কিছু একটা লেখা আছে। যার পাঠোদ্ধার করা এখনও পর্যন্ত সম্ভব হয়নি। এই মন্দিরে আর একটা বিগ্রহ আছে সূর্যদেবের। নিত্য পূজিত হন তিনি।





গর্ভমন্দিরের এই দেবী মন্দিরটি কে কবে কোথায় প্রথম প্রতিষ্ঠা করেছিলেন? আদিম পুজো বেদিই বা কোথায় ছিল? এসব বিষয়ে কোনকিছু জানা যায়নি আজও। তবে লোকশ্রুতি আছে, বর্ধমানের উত্তরে সর্ব্বমঙ্গলা পল্লী। এখানে এক বাগদী বাড়িতে ছিল দেবী বিগ্রহটি। বাগদীরা ছোট এক টুকরো পাথরখণ্ডের ওপর ভাঙত গেঁড়ি, গুগলি, ঝিনুক, শামুক ইত্যাদি।





স্থানীয় চুনোলিরা পরে এসে খোলগুলো কুড়িয়ে নিয়ে যেত চুন তৈরি করার জন্য। একদিন গুগলি, ঝিনুকের সাথে পাথরখন্ডটিও নিয়ে যায় চুনোলিরা। খোলগুলো পোড়ানোর সময় পাথরখন্ডটিকেও আগুনে দেয় তারা। খোলগুলো আগুনে পুড়ে গেলেও শেষপর্যন্ত অবিকৃত থেকে যায় কালো রঙের পাথরখন্ডটি। পরিস্কার করে খোদাই করা মূর্তি দেখে অবাক হয়ে যায় তারা।





এরপর কৌতূহলবশে পাথরখন্ডটিকে স্থানীয় এক ব্রাহ্মণের বাড়িতে নিয়ে যান চুনোলিরা। ব্রাহ্মণ ধুয়ে মুছে আরও পরিস্কার করে দেখেন পাথকখন্ডটিতে খোদিত আছেন এক অপরূপা দেবীমূর্তি। ইতিমধ্যে বর্ধমানের মহারাজ চিত্রসেন রায় স্বপ্নে দেখেছেন এক দেবীমূর্তি তাঁকে আদেশ দিয়ে বলছেন দেবী অবহেলিত অবস্থায় পড়ে আছেন দামোদরের জলে। মহারাজ যেন দেবীকে উদ্ধার করে এনে প্রতিষ্ঠা করেন।





অপ্রত্যাশিত এমন স্বপ্নে বিস্মিত ও মোহিত হলেন মহারাজ। ভোর হতেই ঘোড়া ছুটিয়ে গেলেন দামোদর তটে। দেখলেন একটা পাথরখণ্ডকে ধুচ্ছেন একজন ব্রাহ্মণ। মহারাজ বিগ্রহটি চাইলেন ব্রাহ্মণের কাছে। কিন্তু মূর্তিটি কিছুতেই দিতে রাজী হলেন না ওই ব্রাহ্মণ। পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে মহারাজ প্রতিশ্রুতি দিলেন ওই ব্রাহ্মণই দেবীর নিত্যপুজোর অধিকারী হবেন। তবে মূর্তিপুজোর যাবতীয় ব্যয়ভার বহন করবেন মহারাজ।





প্রস্তাবে সম্মত হলেন ব্রাহ্মণ। মহারাজ কীর্ত্তিচাঁদ নির্মিত মন্দিরে দেবী সর্ব্বমঙ্গলা প্রতিষ্ঠিত হলেন মহাসমারোহে। ব্রাহ্মণ পেলেন নিত্যপুজোর ভার। সেই থেকে আজও মা সর্ব্বমঙ্গলা নিত্যপুজো পেয়ে আসছেন চিরাচরিত প্রথা মেনে অপ্রতিহত গতিতে। বর্ধমানের অধিষ্ঠাত্রী দেবী সর্ব্বমঙ্গলার প্রাচীনত্বের প্রমাণ পাওয়া যায় মঙ্গলকাব্যে। রূপরাম চক্রবর্তীর ধর্মমঙ্গলেও আছে দেবীর উল্লেখ।





সর্ব্বমঙ্গলা মন্দিরের প্রধান পুরোহিত জানালেন, সকালে মন্দির খোলার পর মাকে মুখ ধুইয়ে সরবত খাওয়ানো হয়। তারপর হয় মঙ্গলারতি। মঙ্গলারতির পর চৌকিতে বসিয়ে তেল মাখিয়ে পঞ্চামৃত দিয়ে স্নান করানো হয় মাকে। এরপর গয়না পরিয়ে সিংহাসনে বসিয়ে নিত্যপুজো হয় তাঁর। লুচি দিয়ে জলখাবার দেওয়া হয় মাকে।





ভক্তরা পুজো দিতে থাকেন। বেলা সাড়ে বারোটা থেকে একটার মধ্যে অন্নভোগ দেওয়া হয়। তারপর মন্দির বন্ধ হয়ে যায়। বিকেলে মন্দির খোলে পৌনে চারটা থেকে চারটের মধ্যে। সকালের মতই স্নান করিয়ে গয়না পরিয়ে সিংহাসনে বসানো হয় মাকে। চলতে থাকে পুজো। রাতে লুচিভোগের মাধ্যমে শীতল দেবার পর শয়ন দেওয়া হয় মাকে। রাত সাড়ে আটটায় বন্ধ হয়ে যায় মন্দির।





বর্ধমানবাসীর একান্ত আপনজন, প্রাণের দেবী মা সর্ব্বমঙ্গলা। অত্যন্ত জাগ্রত দেবীর কাছে কোন কামনা করে তা পূরণ হয়নি এমন কথা শোনাই যায়না। সেজন্যই তো প্রতিদিন দূর-দূরান্তের অগণিত নরনারী ছুটে আসেন সর্ব্বমঙ্গলা দর্শনে। শনি-মঙ্গলবার মন্দির প্রাঙ্গণে ভিড় থাকে প্রচুর। সামান্য প্রণামীর বিনিময়ে দুপুরে মায়ের অন্নপ্রসাদ পাওয়া যায় পেটভরা।





তবে নাম লেখাতে হয় সকাল সাড়ে দশটার মধ্যে। সর্ব্বমঙ্গলার জমকালো পুজো হয় দুর্গাপুজোর সপ্তমী থেকে নবমী পর্যন্ত। সেসময় মন্দিরের চারদিকে সমারোহে মেলা চলে পাঁচদিন। নবমীতে পাঁঠা ও মেষ বলি হয়। যেকোনও উৎসব-অনুষ্ঠানে, বিবাহে, অন্নপ্রাশনে, পয়লা বৈশাখ ও অক্ষয়তৃতীয়ায় ব্যবসায়ীদের নতুন খাতার শুভ সূচনায় বর্ধমানবাসীর কাছে মা সর্ব্বমঙ্গলার আশীর্বাদ একান্ত কাম্য।
























